ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভেষজ ওষুধ কি ইনসুলিন এর বিকল্প হতে পারে?


নানাধরনের গাছগাছড়া খেয়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। ভারত, চীন, আরব, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা বা অষ্ট্রেলিয়ার মতো দেশে এরকম বেশ কিছু গাছ ডায়াবেটিসের বিজ্ঞানসম্মত ওষুধগুলোর পাশাপাশি অথবা বিকল্প হিসেবে আজও ব্যবহার করা হয় ব্যাপকভাবে। সারা বিশ্ব জুড়ে সাতশোরও বেশি গাছ (পাতা, ছাল, শিকড় ইত্যাদি) ডায়াবেটিসে শর্করা-নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে জানা গেছে। এর বেশিরভাগই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এশিয়া বা আফ্রিকার উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে।

ইনসুলিনের কোনও ভেষজ বিকল্প নেই। থাকতে পারেও না। তবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এমন কিছু উদ্ভিদে রক্তে শর্করা কমানোর উপাদানে রয়েছে নানামাত্রায়। এই গাছগুলোকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিজ্ঞানসম্মত রীতিনীতি মেনে। বার করা সম্ভব হয়েছে এদের মধ্যে থাকা শর্করা কমানোর রাসায়নিকগুলোকে। বাস্তবে ‘ডায়াবেটিসের চিকিৎসা’ হিসাবে ব্যবহৃত বেশিরভাগ গাছ নিয়েই এরকম পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত হয়নি। এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে তাই সন্দেহ থাকা অমূলক নয়। যে কোনও রোগের চিকিৎসায় ভেষজ ব্যবহারের বড় একটা অসুবিধা রয়েছে। ওই রোগে কাজ করে এমন রাসায়নিক ছাড়াও অন্য অনেক রাসায়নিক ওই ভেষজে থাকতে পারে। বাস্তবে থাকেও । গাছের পাতা, ছাল বা শিকড় খেয়ে কোনও রোগ সারাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় রাসায়নিকটির দীর্ঘমেয়াদী প্ৰতিক্রিয়া বেশিরভাগ সময় অজানা। উদ্ভিদ দিয়ে চিকিৎসায় তাই রোগে কর্মক্ষম রাসায়নিকটিকে আলাদা করে বার করে ফেলার চেষ্টা করা হয় । সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে পাওয়া অনেক রাসায়নিকের ভেতর থেকে যেভাবে বার করা সম্ভব হয়েছে ম্যালেরিয়াতে কার্যকরী ওষুধ কুইনাইনকে।

বাস্তবে কোনও রোগে কার্যকর গাছপালায় কার্যকরী রাসায়নিকটি থাকে খুবই কম মাত্রায়। রোগের চিকিৎসায় যথেষ্ট মাত্রায় ওই রাসায়নিকটি পেতে প্রচুর পরিমাণে গাছের ছাল-পাতা বা শিকড় খাওয়া দরকার। ব্যবস্থাটি অসুবিধাজনক। শুধু তাই নয়, ওই পরিমাণ রাসায়নিকের সঙ্গে অন্য নানা রাসায়নিক শরীরে ঢোকে। যা থেকে শরীরী প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় যেসব ভেষজ নিয়ে গবেষণা হয়েছে, তাদের সব কটিতেই শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী রাসায়নিকটি থাকে খুব সামান্য মাত্রায়। ওই উপাদানকে আলাদা করে ওষুধ বানানোর চেষ্টা বেশিরভাগ সময় তাই বিপুল খরচসাপেক্ষ। এরকম পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয় বলেই পরিত্যক্ত হয় বারবার।

তা ছাড়া এখন বাজারে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট কার্যকরী ওষুধ রয়েছে। এইসব ওষুধের তুলনায় আগে বলা উদ্ভিদগুলোতে থাকা রাসায়নিকের শর্করা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনও সুবিধা নেই। যেমন, ধরা যাক এদেশে নানা রোগে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় এমন উদ্ভিদ চিরতার কথা। মোমোরডিকা চিরানসিয়া নামের এই উদ্ভিদে থাকা অ্যালকালয়েড চ্যারানটিন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। তবে চিরতায় এই রাসায়নিকটি থাকে খুবই অল্প পরিমাণে।

কোনও ডায়াবেটিসের রোগী চিরতা খেয়ে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তাকে যে বিপুল পরিমাণ চিরতা নিয়মিত খেতে হবে বাস্তবে তা সম্ভব নয়। আবার চিরতায় থাকা ওই অ্যালকালয়েডটির তুলনায় অনেক কার্যকরী একক ওষুধ রোগী খেতে পারেন অনায়াসে। বাস্তবে খানও। ওই ওষুধের পাশাপাশি সামান্য চিরতার জল রোগী নিয়মিত খেতেই পারেন। এতে তিনি মানসিক শান্তি পেলে সুস্থ জীবনযাপন সহজতর হবে সন্দেহ নেই। এদেশের মানুষের মনে গাছ-গাছড়ার রোগ সারানোর ক্ষমতার ব্যাপারে বিশ্বাস গভীর। এই বিশ্বাসে এত টুকু আঘাত না করেও বলা যায়, ভেষজ সব ওষুধের কাৰ্যকারিতা, প্রয়োজনীয় মাত্রা ও শরীরী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া গবেষণার অভাবে আজও সঠিকভাবে জানা নেই। কোনও ভেষজকে আধুনিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এরকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা জরুরি।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় এদেশে উচ্ছে, করলা থেকে শুরু করে নানা উদ্ভিদের ব্যবহার বহুলপ্রচলিত। এগুলো নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই হয়নি। ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশান অব ইন্ডিয়ার কলকাতা-র তত্ত্বাবধানে এরকম গবেষণা শুরু হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও বেশ কিছুদিন।

কোনও অবস্থাতেই কোনও উদ্ভিদ বা ভেষজ ডায়াবেটিসের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার বিকল্প নয়। বিকল্প নয় ইনস্যুলিনের। বাজারে প্রচলিত ওষুধের তুলনায় গাছগাছড়ার প্রতিক্রিয়া কম—এরকম ধারণা বহুলপ্রচলিত হলেও বাস্তবসম্মত নয়।

তথ্যসূত্র: হাতের মুঠোয় ডায়াবেটিস –ড. শ্যামল চক্রবর্তী

 

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত, কার্যকর ও আসল ইনসুলিন কিনতে এখানে ক্লিক করুন